বার্তা ডেস্কঃ
দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকারও স্বীকার করেছে। জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার উত্থাপন করা ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পাচার করা অর্থ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনতে এমন পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, এমন সিদ্ধান্ত অনৈতিক। এমন সুযোগ দিয়ে টাকা পাচারকারীদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়, বিদেশে থাকা যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তি ১০ শতাংশ এবং নগদ টাকা আনতে চাইলে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করা যাবে।
এনবিআর বলেছে, এসব শর্ত মেনে কেউ পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনলে পাচারকারীর আয়ের উৎস সম্পর্কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন, এমনকি সরকারি অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। চলতি বছরের জুলাই থেকে আগামী ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুযোগ দেয়া হবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে বাজেট বক্তব্যে অর্থ পাচারকারীদের এমন সুযোগ দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার পর এমন সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
তারা বলেন, এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিদ্যমান সুযোগ রহিত করা হলেও পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভিন্ন উপায়ে কালো টাকা নতুন করে সাদা করার সুযোগ দিয়েছে সরকার।
পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়ে প্রকারান্তরে অর্থ পাচারকারীদের পুরস্কৃত করল সরকার। এই সুবিধা দেয়ার ফলে দায়মুক্তিতে উৎসাহিত হবে অর্থ পাচারকারীরা। এ ধরনের দায়মুক্তিতে দুর্নীতি ও টাকা পাচার উৎসাহিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যবসায়ীরা পাচার করা টাকা ফেরত আনতে চান না। কারণ তারা নিজেদের প্রয়োজনেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাকা এবং বাড়ি-গাড়ির মতো স্থাবর সম্পদ রাখেন।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, যে অর্থ পাচার হয়ে গেছে তা দেশে আনা মানেই এক ধরনের জটিলতায় পড়া। এ কারণে সুযোগ দিলেও অর্থ ফেরত আনবেন না তারা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড.এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার পরিবর্তে কে কোন সূত্রে বিদেশে টাকা পাচার করেছে তা চিহ্নিতকরণে উদ্যোগ নেয়া দরকার। এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনসহ অন্যান্য আইন জোরালোভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই সুযোগ দেয়ার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশে বসে অর্থ চুরি করে সেই অর্থ চুরি করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া। এখন সেই চুরির টাকা সোনার চামচ দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হলো।
‘সরকার যদি প্রকৃত অর্থেই এ সুযোগ দেয় তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বন্ধ করে দেয়া দরকার। পাচারের দায়ে অভিযুক্ত পি কে হালদারকেও সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ফুলের মালা পরিয়ে দেশে নিয়ে আসা উচিত।’
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম মনে করেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগ বৈষম্যমূলক। কারণ এই সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে সরকার পাচারকারীদের পুরস্কৃত করেছে। একইসঙ্গে নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত করেছে।’
অর্থ পাচারকারীদের দণ্ড মাফ করে দেয়ার উদ্যোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এটি আইন ও দেশের সংবিধান পরিপন্থী।’
পাচারকারীদের সুবিধা দিলে দেশে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার আরও উৎসাহিত হবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার দিয়ে এসেছে। তবে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ আগে কখনও দেয়া হয়নি।
বাজেটের আগে ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশই পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে নানা সুবিধা দিয়েছে এবং পাচার বন্ধে কঠিন আইনও করেছে।
অর্থ পাচার প্রমাণ হলে জেল-জরিমানার মতো কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। সেই অপরাধীদের কিছু সুবিধা দিয়ে দণ্ড মাফ করতে যাচ্ছে সরকার।
রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও আইনি জটিলতার কারণে তা ফেরত আনা যাচ্ছে না। কিছু সুবিধার বিনিময়ে পাচারকারীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘোষণা দিলে ওই টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় যোগ হবে। এতে সরকার ও পাচারকারী উভয়েই লাভবান হবে।
একশ্রেণির ব্যবসায়ী আমদানি পণ্যের দাম বেশি এবং রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে অর্থ পাচার করেন। কর ফাঁকি এবং হুন্ডির মাধ্যমেও প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে থাকে।
দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনায় সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদরা জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে গত বছর সংসদে তোপের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। বিরোধী সাংসদদের কাছে অর্থ পাচারকারীদের নাম চেয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ৫ বছরে এক হাজার ২৪টি পাচারের ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে। বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৮টি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২১টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৭৭টি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫২টি ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১৬টি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে পাচারকারীরা দেশের বাইরে কোথায় ফ্ল্যাট ও বাড়ি কিনেছেন কিংবা বিনিয়োগ করেছেন, সেগুলোর বিবরণও আছে।
এসব তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআর, বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো হলেও খুব কম ক্ষেত্রেই তদন্ত ও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা বলা হলেও দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয়েছে তার কোনো তথ্য সরকারের হাতে নেই।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা।